
শ্রম বাজারে মানুষের অস্তিত্ব কি বিপন্ন?
পণ্য উৎপাদনের মানুষের কায়িক শ্রমের পরিমাণ অনেকাংশে কমিয়ে দিয়েছিল শিল্প বিপ্লব। এরপর যত দিন গেছে, যন্ত্রের উপর মানুষের নির্ভরশীলতা ততই বেড়েছে। তবে যন্ত্র চালানোর ভারটা এখন পর্যন্ত মানুষের হাতেই আছে। ধীরে ধীরে সেই জায়গাতেই ভাগ বসাচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রোবট। যত দিন যাচ্ছে, রোবট ততই উন্নত হচ্ছে। আর সেই হারেই বিপন্ন হচ্ছে শ্রমিক। অনেক বিশেষজ্ঞ ধারণা করছেন, বর্তমানে শিল্প-কারখানায় রোবটের ব্যবহার যে হারে বাড়ছ, তাতে হুমকিতে পড়তে পারেন শ্রমিকেরা।
একটি নতুন গবেষণা পত্র জানাচ্ছে, ১৯৯০ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পকারখানায় যদি একটি করে রোবট যুক্ত হয় তবে এর জন্য প্রতি এক হাজার শ্রমিকের মধ্যে ৬ জনের চাকরি গেছে। মানুষের সঙ্গে ঘোড়ার তুলনা করা হয়তো বুদ্ধিমানের কাজ নয়, কিন্তু গত শতকের প্রথম ৫০ বছরে চারপেয়ে ওই জীবের ভাগ্যও এমনই হয়েছিল। ইঞ্জিন চালিত গাড়ি ও ট্রাক্টরের দাপটে ১৯১০ থেকে ১৯৫০ সালে ঘোড়ার চাহিদা কমে গিয়েছিল প্রায় ৮০% শতাংশ।
এই গবেষণাপত্রের লেখক ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির ড্যারন আদজেমোওলু ও বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাসকুয়েল রেসত্রেপো এ নিয়ে বিস্তারিত জরিপ করেছেন। তাদের মতে, রোবটের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় স্বল্প-শিক্ষিত শ্রমিক থেকে শুরু করে স্নাতক পাশ করা ব্যক্তিরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। রোবট ব্যবহার শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ৩ লাখ ৬০ হাজার থেকে ৬ লাখ ৭০ হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছেন। অন্যদিকে সারা বিশ্বে রোবটের কারণে যত শ্রমিকের চাকরি গেছে, তাদের অর্ধেকের ক্ষেত্রে রোবটকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক রোবটিক্স ফেডারেশনের দেওয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী, কারখানায় ব্যবহার করা রোবট হলো এমন এক ধরনের যন্ত্র, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং এর প্রোগ্রামের পরিবর্তন করা যায়। শুধু একটি কাজে ব্যবহার করা যন্ত্রকে এক্ষেত্রে রোবট হিসেবে গণ্য করা হয় না। সারা বিশ্বে এমন রোবটের সংখ্যা ২০ লাখের কিছু কম; যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি এক হাজার শ্রমিকের জন্য দুটি রোবট বরাদ্দ আছে। তবে ইউরোপে এ সংখ্যা দুইয়ের বেশি। আর এমন রোবটের ব্যবহার প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। ফলে রোবটের কারণে কাজ হারানো বেকারের সংখ্যা বাড়ছে।
এ ধারণার উল্টো মতও আছে। কোন কোন বিশেষজ্ঞ মনে করেন, মানুষ প্রাণী জগতের শ্রেষ্ঠ জীব হয়েছে তার খাপ খাওয়ানোর অসাধারণ ক্ষমতার কারনেই। সুতরাং মানুষ যদি রোবটের কারণে শ্রমবাজারে অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়ে, তবে তাও কোনোও বিকল্প ব্যবস্থায় সামলে নিতে পারবে।
রোবট ব্যবহারের ফলে স্বাভাবিকভাবেই উদ্যোক্তা ও ভোক্তাদের খরচ কম হচ্ছে। আর সেই সঞ্চয় অন্য খাতে খরচ করতে পারছেন তারা। উন্নত প্রযুক্তির কারণে যে শ্রমিকেরা উদ্বৃত্ত হয়ে পড়েছেন বা ভবিষ্যতে পড়বেন, তাদেরও এভাবে অন্য কোন কাজে লাগানোর চেষ্টা করা যেতে পারে বলে জানাচ্ছেন বিশ্লেষকরা। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় মানুষের সুবিধা বেশি। এর মূল কারণ অবশ্যই তুলনামূলক উন্নত মস্তিস্ক।
কিন্তু রোবট ব্যবহারের কারণে শ্রমিকরা আর কোন সমস্যায় মুখোমুখি হতে পারেন? দুই গবেষক ড্যারন আদজেমোওলু ও প্যাসকুয়েল রেসত্রেপো বলেন, এ কারণে কমে যাচ্ছে শ্রমিকদের মজুরি। তাদের দেওয়া হিসেবে দেখা গেছে, এক হাজার শ্রমিক এর পেছনে অতিরিক্ত প্রতিটি রোবটের জন্য সামগ্রিক অর্থনীতিতে মজুরি কমছে ০.৫ শতাংশ হারে। ধনী দেশগুলোয় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শ্রমিকদের মজুরি আগের তুলনায় খুব কম বেড়েছে। তবে শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় কম মজুরির চাকরির সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।
সুতরাং প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে শ্রম বাজারে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হলে যন্ত্রের সঙ্গে চতুরভাবে পাল্লা দিতে হবে মানুষকে। সমাজ ও রাষ্ট্রকে হতে হবে কুশলী। তা না হলে বেকার মানব সম্পদ হয়ে উঠবে সভ্যতার অন্যতম সংকট।
লেখকঃ অর্ণব সান্যাল
সুত্রঃ দ্য ইকোনমিস্ট